সংবাদচর্চা রিপোর্ট
চলছে হরিলুট দেখবে কে? ধুকছে মানুষ শুনবে কে? যে যা করছে তাই আইন, আইন আছে তবে জানা নেই অনেকের। আর জানার জন্য যথেষ্ট প্রচার করছে কি?
ভোক্তা সংরক্ষণ অধিদপ্তর। ২০০৯ সালে বর্তমান ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগ এই গুরুত্বপূর্ণ আইনটি বাস্তয়ন করে প্রতিটি জেলায় অধিদপ্তর স্থাপন করে বিশাল কর্মযোজ্ঞ পরিচালনা করে ভোক্তা অধিকার নিশ্চিত করার লক্ষে সরকারে এই উদ্যোগ। যুগপোযোগী প্রচার-প্রচারনা না থাকায় দেশের আপামর সাধারণ মানুষ এই আইন সম্পর্কে তেমন সচেতন নয় এবং জানেনা নরায়ণগঞ্জবাসীও। আর যারা জানেন তারা প্রয়োগ করছেন কি না তারও নেই শুনির্দিষ্ট ধারনা।
রাষ্ট্রের প্রতিটি নাগরিকই ভোক্তা। একজন ভোক্তা হিসেবে রয়েছে তার ‘ভোক্তা অধিকার’। কিন্তু ভোক্তার অধিকার কি, তা জানে না ভোক্তাই। প্রতারিত হলে কি করতে হবে, কোথায় যেতে হবে তাও ভোক্তাদের অজানা। ভোক্তা অধিকার নিয়ে যেসব সংগঠন কাজ করছেন, সেসব সংগঠনের কার্যক্রম দেখা যায় শুধু ভোক্তা অধিকার দিবসেই। দিনব্যাপী আলোচনা, মানব বন্ধনের মধ্যেই যেনো চাপা পড়ে থাকে ভোক্তার প্রকৃত অধিকার। বিগত ২০০৯ সালে সরকার ভোক্তাদের অভিযোগ দেওয়ার জন্য ‘জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর’ নামে নতুন একটি অধিদপ্তর খুললেও সেখানে কি পরিমান অভিযোগ এসেছে ক্ষতিয়ে দেখতে হবে।
দৈনিক সংবাদচর্চার অনুসন্ধানকালে গত বৃহস্পতিবার সরেজমিনে খোজ নিয়ে দেখা যায় নারায়ণগঞ্জ সদর উপজেলাধীন চাঁনমারীস্থ ফরিদা বিল্ডিং এর ৫ম তলায় অবস্থিত জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর, নারায়ণগঞ্জ জেলা কার্যালয় অফিসের গেইটে তালা ঝুলানো। পাশের অফিসের একজন কর্তাকে জিজ্ঞেস করলে তিনি জানান, এই অফিস আজ বন্ধ। অফিসের লোক মিটিংয়ে গেছেন।
আজ তাদের পাওয়া যাবে না। তবে রবিবার আসলে তাদের দেখা পাওয়া যেতে পারে বলে তিনি এই প্রতিবেদককে বিষয়টি নিশ্চিত করেন।
চাঁনমারীস্থ ফরিদা বিল্ডিং এর বিভিন্ন সরকারি অফিস সূত্রে জানা যায়, নারায়ণগঞ্জের এই জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষন অধিদপ্তর মাত্র দু’জন বসেন। একজন অফিস সহকারী যিনি বর্তমানে কম্পিউটারের প্রশিক্ষণ গ্রহণ করছেন যার কারনে গত কিছুদিন যাবৎ তিনি নিয়মিত অফিস করতে পারছেন না। অপর একজন মেডাম আছেন যিনি অধিকংশ সময়ই বিভিন্ন মিটিং এ ব্যস্ত থাকেন তবে মাত্র দু’জন লোক দ্বারাই এই অফিস পরিচালিত হয়ে আসছে।
‘সামাজিক রোগতত্ত¡বিদ্যা’ এবং ‘রাজনৈতিক রোগতত্ত¡বিদ্যা’র নানা গবেষণার মূল প্রতিপাদ্য যেসব দেশে রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলো সৎ, স্বচ্ছ, দায়িত্বশীল, দুর্নীতিমুক্ত, জবাবদিহিমূলক এবং সুশাসনযুক্ত সেই সব দেশে নাগরিকের আয়ু বেশি, শারীরিক-মানসিক সুস্থতা অতুলনীয়, রোগ-বালাই কম, রোগপ্রতিরোধশক্তি বেশি ইত্যাদি। এই তালিকা দীর্ঘ। শারীরিক সুস্থতার কারণ মানসিক সুস্থতা। মানসিক সুস্থতার কারণ নাগরিকের সুনিদ্রা ও কম টেনশন। সুনিদ্রা ও টেনশনমুক্তির কারণ রাষ্ট্রের মূল চারটি প্রতিষ্ঠান-আইন, শাসন, বিচার ও নিরাপত্তার সততা, স্বচ্ছতা, দায়িত্বশীলতা, দুর্নীতিমুক্ততা, জবাবদিহিমূলকতা এবং সুশাসন। ন্যায্যতা নিশ্চিত, সুবিচার ও সুশাসন নিশ্চিত-তাই নাগরিক সুনিদ্রা দেয়, টেনশনমুক্ত থাকে। মানবিক, পরোপকারী ও সংবেদনশীল হয়। দেশগুলোর জনগণ সুখী, বসবাসযোগ্য ও শান্তিবাদী থাকে। কারণ তারা জানে ‘আমরা সবাই রাজা’ বা ‘আমরাই ক্ষমতাধর’। তাদের আত্মবিশ্বাস, সাহস, মনোবল, মতপ্রকাশের ও সত্য কথা বলার সৎসাহস তৈরি হয়। অগণতান্ত্রিক দেশের হিসাব সম্পূর্ণ বিপরীত। জনগণ তো বটেই, দেশগুলোই একধরনের ভয়াবহ শারীরিক-মানসিক অসুস্থতার আবর্তে ঘুরপাক খেতে থাকে।
নারায়ণগঞ্জের এক শ্রেণির ব্যবসায়ীরা তাদের অধিক মুনাফা লাভের আশায় দিনকে দিন পন্যের মূল্য বৃদ্ধি করে যাচ্ছেন। পন্যের মান বাড়ছে কিনা নজর কম থাকলেও পন্যের দাম বাড়াতে তারা বেশি তৎপর। এ সকল ব্যবসায়ীদের লাগাম টেনে ধরার জন্যই সৃষ্ট ভোক্তা অধিকার সংরক্ষ আইন যা ২০০৯ সালে বাস্তবায়ন হয়। তবে দীর্ঘ ৯ বছর অতিক্রম করলেও এই আইনের প্রয়োগ নিয়ে রয়েছে ঘোর সংশয়। নগরীর অলিগলিতে ছেঁয়ে যাওয়া বিভিন্ন বাজার, হোটেল, ডিপার্টমেন্টার স্টোরগুলো কিভাবে তাদের ব্যবসা পরিচালনা করছে, সঠিক দামে সাধারণ গ্রাহক তার কাঙ্খিত সেবাটি পাচ্ছে কিনা সে সকল বিষয়ে তদরকি করার দায়িত্বই তাদের কিন্তু প্রশ্ন হলে তদারকি হচ্ছে কি?
গতকাল সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, বঙ্গবন্ধু সড়ক সংলগ্ন কালীরবাজার স্বর্ণপট্টিমোড়স্থ নিউ দীপা সুইট মিট হোটেলে পরোটার দাম ৬ টাকা, ভাজী প্রতি প্লেট ১৫টাকা। নিউ দীপা সুইট মিট হোটেলের পাশেই রয়েছে সুমাইয়া বিরানী হাউজ। এই বিরানি হাউজটিতে সন্ধার পর বিক্রি করা হয় পরোটা ও ডাল-ভাজী। পরাটার দাম কত জানতে চাইলে দোকানের এক কর্মচারী জানান, প্রতি পিস পরোটা ৫টাকা এবং ডাল-ভাজী ১২ টাকা। পাশাপাশি দোকান তারপরও কেন মূল্যের হেরফের জানতে চাইলে ঐ কর্মচারী কিছু বলতে অপরাগত প্রকাশ করে।
দামের এই হেরফের সম্পর্কে নিউ দীপা সুইট মিট কর্ণধারের সাথে আলাপকালে তিনি জানান, অন্যান্য হোটেলের তুলনায় আমাদের হোটেলের পরটা বড় বিধায় ৫টাকার পরিবর্তে ৬টাকা রাখা হয়। নিউ দীপা সুইট মিট এর পার্শ্ববর্তী সুমাইয়া হোটলের পরিদর্শন কালে দেখা যায় তাদের পরটার সাইজ এবং নিউ দীপা সুইটমিট এর পরটার সাইজের মধ্যে কোন পার্থক্য নেই।
বেশ কিছুদিন পূর্বে ইন্টারনেট ও বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে নিউ দীপা সুইটমিট হোটেলের খাবারের মান নিয়ে বেশ কিছু পোষ্ট শেয়ার হতে দেখা যায়। অধিকাংশ ব্যবহারকারী নিউ দিপা সুইটমিট এর পরোটার দাম ও বাসি, পঁচা আলু ও নিম্ন মানের তেল ব্যবহারের বিষয়ে বেশ কিছু পোষ্ট শেয়ার করে যা নগরবাসীর দৃষ্টিগচর হয়।
এছাড়া চাষাড়াস্থ সান্তনা মার্কেটের নিচতলার ঘরোয়া রেষ্টুরেন্টে গিয়ে দেখা যায়, আগের দিনের বাসি খাবার নুতন খাবারের সাথে মিক্স করে প্রতিদিন বিক্রি করছে। অপর দিকে নারায়ণগঞ্জ মহিলা কলেজের পশ্চিমে অবস্থিত বৈশাখী রেস্তরায় গিয়ে দেখা যায়, অবিক্রিত মুরগীর গ্রীলগুলো দিয়ে প্রতিদিন ঝাল ফ্রাই প্রস্তুত করে করা হয় এবং গ্রাহকদের অন্ধকারে রেখে তারা দীর্ঘ দিন ধরে এই অনিয়ম গুলো পরিচালনা করে আসছে। এই ভাবেই এক শ্রেণির প্রতারক ব্যবসায়ীরা বছরের পর বছর ধরে সাধারণ গ্রাহকদের সাথে প্রতরানা পূর্বক নিজেদের অঢেল সম্পত্তি মালিক হিসেবে গড়ে তুলছেন।
শহরের বেশ কিছু হোটেল গ্রাহকদের সাথে কথা বললে তারা ক্ষোভের সাথে জানায়, অভিযোগ করলে কর্তৃপক্ষের টনক নড়ে! অভিযোগ না করলে তাদের করার মত কিছুই থাকে না এই সংস্কৃতি আর কত দিন চলবে? তাদেরও তো কিছু দায়িত্ব আছে, আছে কিছু কর্তব্য। আমাদের সাধারণ মানুষের কষ্ট আর মহনতের টাকায় তাদের বেতন ভাতা প্রদান করা হয়। অন্ততপক্ষে আমাদের মহনতের টাকাটা তারা হালাল করে গ্রহণ করুক। ভোক্তা সংরক্ষনের মত একটি আইন দেশে বিদ্যমান আছে কিন্তু আমরা সাধারণ মানুষ এর কিছুই জানিনা। তারা না করছে অভিযান পরিচালনা না করছে প্রচার প্রচারনা। তাহলে এই ভোক্তা অধিকার সংরক্ষন অধিদপ্তরের ভ‚মিকাটা কী? শুধুই কি লোক দেখানো ?
পশ্চিমা বিশ্বের প্রসঙ্গ টানলে অনেকেই বলেন, বাংলাদেশ পশ্চিমা নয়; কোথায় আগরতলা কোথায় জারুলতলা ইত্যাদি। এই আত্মপ্রতারণামূলক আত্মপ্রবোধ অর্থহীন। উদাহরণ পশ্চিমা বিশ্ব হলেও মূল প্রসঙ্গ মোটেই বহির্বিশ্ব নয়; বরং প্রতিষ্ঠান ও প্রাতিষ্ঠানিকীকরণ যে সংসদীয় গণতন্ত্রের অত্যাবশ্যকীয় শর্ত, সেই বৈশ্বিক সত্যের ইঙ্গিত দেওয়া। ধনী কিংবা দরিদ্র, উন্নত বা অনুন্নত যেকোনো দেশই হোক না কেন সৎ, স্বচ্ছ, জবাবদিহিমূলক ও দায়িত্বশীল রাষ্ট্রচরিত্র সবখানে একই। মানবদেহের মতো। সাদা-কালো, লম্বা-বেঁটে হলেও সব মানুষের রক্তের রং, রক্তসঞ্চালন, হৃৎপিন্ড, স্নায়ুতন্ত্র, পরিপাকতন্ত্র যেমন একই রকম, রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোর বা রাষ্ট্রের মূল অঙ্গগুলোর কাজও সব দেশে একই রকম।
সামাজিক ও রাজনৈতিক রোগতত্ত¡বিদ্যার আলোকে বাংলাদেশও একটি অসুস্থ রাষ্ট্র। আদুল আদুল চর্বিযুক্ত শরীর যাকে ‘উন্নয়ন’ বলা হচ্ছে, তার নিচে অসংখ্য দগদগে ঘা, আর কিলবিল করা রোগজীবাণু। রুগ্ণ; রোগপ্রতিরোধ-ক্ষমতা নেই। বাংলাদেশের রাষ্ট্রিয় প্রতিষ্ঠানগুলোকে যখন পুরোপুরি রোগগ্রস্থ করে তোলা হয়েছে, তখন আরও রোগ বাঁধানোর পক্ষে যেকোনো যুক্তিই কুযুক্তি। রোগ নিরাময়ের যুক্তিই সুযুক্তি। সমাজচিন্তকদের দায়িত্ব হোক রোগের পক্ষে জিকির-কীর্তন বন্ধ করা এবং একটি একটি করে রোগ ধরিয়ে দিয়ে সারানোর ও চিকিৎসার সুপরামর্শ দেওয়া। এ সত্যটি বলা যে রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠানগুলোকে সুস্থ-সবল রেখে তাদের নিজ নিজ দায়িত্ব সঠিকভাবে পালন করতে দেওয়ার নামই গণতন্ত্র।
উপরোক্ত বিষয়ের প্রক্ষিতে নারায়ণগঞ্জ ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের সহকারী পরিচালক তাহমনি রহমানের মুঠোফনে যোগাযোগ করে নারায়ণগঞ্জের বিভিন্ন খাবারের হোটেল ও রেস্টুরেন্টগুলোর দামের হেরফের সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি সংবাদচর্চাকে জানান, কোন হোটেলে কিংবা দোকানে নির্ধারিত মূল্যের তালিকা অনুযায়ী বেশি দামে পন্য বিক্রি করে তাহলে আমরা অভিযোগের ভিত্তিতে অবশ্যই ব্যবস্থা গ্রহণ করবো।
এ ছাড়া কোন ব্যক্তি কিংবা ভোক্তা আমাদের দপ্তরে লিখিত আকারে অভিযোগ দায়ে করেন তাহলে আমি এবং আমার দপ্তর বিষয়টি ক্ষতিয়ে দেখে যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করবো।
তিনি আরো জানান, আমরা যে সকল অভিযোগগুলো পাচ্ছি তার প্রেক্ষিতে আমাদের অভিযান বর্তমানে চলমান রয়েছে।
উল্লেখ্যযে, নারায়ণগঞ্জ ভোক্তা অধিকার সংরক্ষন অধিদপ্তরের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা বিভিন্ন কার্যক্রমের কথা বললেও নারায়ণগঞ্জ নাগরীক কমিটির সভাপতি এবং নারায়ণগঞ্জ ভোক্তা অধিকার সংরক্ষন অধিদপ্তরের সাবেক ট্রাষ্টি সভাপতি এবি সিদ্দিকের মতে সবই লোক দেখানো। বছরের এক দিন তারা শুধু র্যালী আর সম্মেলন করে সরকার ও সাধারণ মানুষদের জানান দেন তারা আছেন তবে বলার মতো বা সমাজে দৃষ্টান্ত স্থাপন করার মতো কোন দায়িত্ব পালন করতে তারা ব্যর্থ হচ্ছেন আদৌ তারা তাদের অর্পিত দায়িত্ব পালন করবেন কিনা সেটাই এখন প্রশ্ন বলে মনে করেন মি. এ.বি সিদ্দিক।